top of page

সোহম পাল

টিক টিক টিক


স্কুলের অ্যানুয়াল মিটিং সেরে ফেরার গাড়িতে উঠতে সন্ধ্যা হয়ে গেলো প্রায়। টুকাইয়ের দূর্গা আণ্টি বোধহয় এতক্ষনে পাততাড়ি গুটিয়ে বাড়িমুখো হয়েছে। ছেলেটা বোধহয় ঘুম ভেঙে কাউকে দেখতে না পেয়ে কাঁদতে লেগেছে! এই এক দোষ দূর্গার, বিকেল গড়ালে আর এক মুহুর্ত থাকবে না। না কোন এক বিদঘুটে টিকটিকি নাকি সন্ধ্যে হয়ে গেলেই মানুষের মনে মনে ভাবা বা বলা যে কোনও অলক্ষুণে কথার শেষে তিনবার ডাকে, তারপরেই নাকি সে কথা ফলতে বেশি দেরি হয় না! কি আজগুবি কথা!? একবার বিরক্ত হয়ে দূর্গাকে বলেছিলাম - "বেশ তো সন্ধ্যে হলে অলক্ষুণে কথা নাহয় নাই ভাবলে, তাহলে তো আর কোনও সমস্যা থাকে না!"।


দূর্গা ভয়ে ভয়ে বলেছিল, "ওই টিকটিকিটা মানুষকে মন্দ কথা, বিপদের কথা ভাবতে বাধ্য করে গো, বউদি! মানুষকে রাগিয়ে দেয়! ও মানুষের মাথা পড়তে পারে, রাগের মাথায় কেউ কোনো বিপদের কথা অথবা কোনো অমঙ্গলের কথা ভাবলেই ওই টিকটিকি ডাক পারে গো!" যত রাজ্যের বিদঘুটে কথা। এসব ভাবতে ভাবতেই বাড়ি এসে পৌঁছই। বাড়ি ফিরে দেখি আমার বাড়ির সামনে জটলা, ভিড় ঠেলে এগিয়ে দেখি দূর্গা অজ্ঞান হয়ে পরে আছে বারান্দায়। মাথায় চাপ চাপ রক্ত ওর। সবার কাছে শুনলাম, দূর্গা নাকি চিৎকার করতে করতে সিড়ি দিয়ে নামার সময় পড়ে গেছে। তাড়াতাড়ি অ্যাম্বুলেন্স ডেকে ওকে হাসপাতালে পাঠালাম, গাড়িতে ওঠার আগে জ্ঞান ফিরেছিল দূর্গার। আমাকে দেখে চোখ বিস্ফারিত করে আঙুল দিয়ে কি যেন দেখাতে চাইল, কথা জড়িয়ে যাচ্ছিল ওর। আমি তাকিয়ে দেখলাম, টুকাই খুব ভয় পেয়ে কান্নাকাটি করছে। খুব স্বাভাবিক টুকাই এর কান্না, নিজের মায়ের থেকে খুব একটা কম ভালোবাসে না ও ওর দূর্গা আণ্টিকে। জন্মের পর থেকে বাবা, মায়ের চেয়ে দূর্গাই ওকে লালন করেছে।


তখনকার মতো সমস্যা মিটিয়ে ফিরলাম হসপিটাল থেকে। দূর্গাকে তিনদিন অবসারভেশনে রাখবে এখন। রাতে ডিনারের পর দীপায়নকে ফোনে সব জানালাম। দুর্গার দূর্ঘটনার কথা শুনে উৎকন্ঠিত হলো ও। দূর্গার দেখাশোনায় যেন কোনো গাফিলতি না হয়, তাও বারবার বলে দিল। আজ বছর খানেক হল একটা প্রজেক্টে দীপায়নের কোম্পানি ওকে বিদেশে পাঠিয়েছে। একা হাতে সংসার চাকরি সব সামলাতে হিমশিম খাই আমি। তবু ভাগ্যিস টুকাইয়ের জন্য ওর দূর্গা আণ্টি ছিল! তবে ভালো কথা হলো, দীপায়ন মাস দুয়েকের মধ্যেই ফিরছে। অন্যদিন বাপের ফোন করার সময় হলেই টুকাই লাফালাফি শুরু করে দেয় কথা বলার জন্য, আজ কোথায় মহারাজ? আজ আর রান্নার ঝামেলায় না গিয়ে দু প্যাকেট বিরিয়ানি এনেছিলাম, এমনি সময় খুব রসিয়ে খেলেও আজ তেমন আগ্রহ করে খেলোও না ছেলেটা। বোধহয় দূর্গা আন্টির জন্য মন খারাপ। আজকাল খুব ইম্যাজিনেটিভও হয়েছে টুকাইটা, কে জানে দূর্গার উদ্ভট গল্প শুনে ভয়টয় পেয়েছে নাকি! নাহ খুঁজে দেখতে হয় একবার।


সারাবাড়ি খুঁজে অবশেষে টুকাইকে পাওয়া গেলো ওরই ঘরে। পড়ার টেবিলের নিচে। কাছে ডেকে কোলে বসিয়ে কি হয়েছে জানতে চাইলে, ও যা বললো তাতে আমার গা পিত্তি জ্বলে গেল। খুব কাঁদোকাঁদো গলায় টুকাই বললো- "মাম্মা আমার জন্যে দূর্গা আণ্টি ব্যাথা পেয়েছে জানো। স্কুলে আজ আমায় নুডুলস টিফিন দেয় নি, এইজন্য আমার একটু রাগ হয়েছিল আন্টির উপর। বাড়ি ফিরে ঘরে ঢুকতেই রাগটা আরো বাড়লো জানো, তখনই আমি মনে মনে ভাবলাম দুষ্টু আণ্টি তোমার মাথা ফাটুক! ওমনি একটা টিকটিকি তিন বার ডাকলো- টিক টিক টিক! কথাটা আন্টিকে বলতেই আণ্টি চেঁচিয়ে সিড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে ব্যাথা পেল.."।


খুব রেগে উঠতে গিয়েও আমি শান্ত হলাম, ঠিক করলাম দূর্গা হসপিটাল থেকে ফিরলে ওকে ছাড়িয়ে দেবো। টুকাইকে বড় স্কুলে দিয়ে দেবো, ওখানেই সময় কেটে যাবে ওর। ইম্যাজিনেটিভ হওয়া ভালো কিন্তু এ তো দেখি সুপারস্টিসিয়াস হয়ে যাচ্ছে ছেলেটা! টুকাইকে বোঝালাম এসব কিছু সত্যি না যেটা হয়েছে, সেটা নেহাতই কাকতালীয়। টুকাই খুব সরল গলায় বললো- "না মাম্মা তুমি দেখো এখুনি পাপার অফিস থেকে ফোন আসবে, পাপা গাড়িচাপা পড়েছে। আজ আমার খুব রাগ হয়েছিল যখন, তখন আমি অনেক খারাপ কথা ভেবেছিলাম। জানো তারমধ্যে এটাও ছিল, আর টিকটিকিটা ডেকেওছিল! ... আরও জানো কি বলেছি..."


আমি আর থাকতে না পেরে রেগে গিয়ে এক চড় মারলাম টুকাইকে। ওর কচিগালে আমার হাতের পাঁচটা আঙ্গুলের দাগ বসে গেল। মুহূর্তে টুকাইয়ের চোখ জ্বলে উঠলো রাগে। তীক্ষ্ণ গলায় চেঁচিয়ে ও বললো- "পচা মাম্মা তুমি একটুও ভালোবাসো না আমায়, শুধু বকো আর মারো। দেখো আমি এখুনি মরে যাবো..."। টুকাইয়ের কথা শেষ হতেই পরিষ্কার শুনতে পেলাম একটা শব্দ। টিক টিক টিক। একটা হিমের স্রোত নেমে গেল আমার পিঠ বেয়ে। তবে ভয়টা জাকিয়ে বসতে দেওয়া গেল না, একটা কল এসেছে মোবাইলে। আই এস ডি কল। ফোনটা ছেড়ে পাথরের মতো বসে পরলাম। এখন কি হবে? এত অল্প সময়ে ফ্লাইটের টিকিট কোথায় পাবো? টুকাইকেই বা কার কাছে রাখবো? অবশ্য দীপায়নের অফিস কলিগরা নিশ্চয়ই সাহায্য করবেন আমায়। রাস্তা পেরোতে গিয়ে একটা গাড়ি দুর্ঘটনা হয়েছে দীপায়নের। বাহাত্তর ঘণ্টার আগে কিছু বলা যাচ্ছেনা। আমাকে কাল ভোরেই বেরোতে হবে। কিন্তু টুকাইকে কে দেখবে! আচ্ছা টুকাই গেলো কই? ভীষণ দুশ্চিন্তার সাথে সাথে একটা অজানা ভয়ও ঘিরে ধরেছে আমাকে। আমি ছুট্টে টুকাইয়ের ঘরে ঢুকলাম। দেখলাম টুকাই বিছানায় শুয়ে। ঘুমিয়ে পড়ল নাকি? কিন্তু ওর বুকটা ওঠানামা করছে না কেন? আমি চিৎকার করলাম- "টুকাই, আই টুকাই !"


টুকাইয়ের সাড়া আর কোনোদিনও পাইনি আমি। ডাক্তার ওর ডেথ সার্টিফিকেটে লিখেছিলেন, আচমকা হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে যাওয়াতে মৃত্যু হয়েছে। সে যাত্রায় দীপায়ন আর দূর্গা দুজনেই ফিরে এসেছিল। তবে ওই বাড়িতে আমরা কেউই আর থাকিনি। দূর্গা গ্রামে ফিরে যায়। আর আমরা অন্য শহরে চলে আসি।


আমি স্পষ্ট বুঝতাম, ওই বাড়ির দেওয়ালে একটা টিকটিকি সবসময় ঘুরে বেড়ায় আর চোখ পিটপিটিয়ে তাকায়। মানুষের মাথা পড়তেও পারে ও, মানুষকে কুচিন্তা করতে বাধ্য করে দেয়। মানুষের মাথার কুচিন্তা পড়ে নিয়ে তিনবার ডাকে। টিক টিক টিক। ওর টিকটিকানো কখনও মিথ্যে হয়না।

2 Comments

Rated 0 out of 5 stars.
No ratings yet

Add a rating
Guest
Sep 09, 2024
Rated 5 out of 5 stars.

Sera dada apni darun lekhen 😶

Like

Soham Paul
Soham Paul
Sep 09, 2024
Rated 5 out of 5 stars.

খুব সুন্দর হয়েছে...অসংখ্য ধন্যবাদ❤️

Like
bottom of page