তনুশ্রী চরিত
- SABDOSANKO
- Sep 9, 2024
- 3 min read
শিউলি মাখা ফ্রক
" এই রুপু তাড়াতাড়ি ওঠ! রেডিওতে মহালয়া শুরু হয়ে গেল যে।"
" উফ! মা, আমার ঘুম পাচ্ছে। মা আবার ঠেলা দিয়ে বলল, "রুপু ওঠ! মহালয়া না শুনলে দুর্গা মা রাগ করবেন। তাহলে আর নতুন জামাটাও কেনা হবে না।"
নতুন জামার কথা কানে আসতেই আমি তাড়াতাড়ি উঠে বসলাম। রোজ স্কুলে যাবার সময় পাড়ার এক রেডিমেড জামাকাপড়ের দোকানে সাজিয়ে রাখা হরেক রকম ফ্রক দেখতে দেখতে যাই। তার মধ্যে দুধ সাদা রংয়ের নেটের একটা ফ্রক খুব মনে ধরেছে। ফ্রকটায় ছোট্ট ছোট্ট শিউলি ফুলের নক্সা কাটা আছে। ঠিক যেন মনে হয় পুজোর দিন সকালে, এক আঁচলা ভরা ফুল নিয়ে, শিউলি মাখা ফ্রক পরে মায়ের কাছে ছুটে যাচ্ছি, অঞ্জলি দেব বলে।
মাকে একদিন কানে কানে মনের কথাটা বলে রেখেছি। অপেক্ষা করে আছি বাবার বাড়ি ফেরার জন্য। বাবা অনেক দূরে, সেই গুজরাটে কাপড়ের মিলে কাজ করে। বছরে দু-বার আসেন বাড়িতে। আমি আর দাদা দুজনে একটা বড় লিস্ট (তালিকা) বানিয়ে রাখি, বাবা বাড়ি আসলে আমাদের কি কি চাই তার জন্য।
তবে পূজোর সময়ের লিস্টটা একদম আলাদা। এতে নতুন জামা কাপড়, শ্যাম্পু, গায়ে মাখার সাবান ,পাউডার, কাজল, ফিতে আরও কত কিছু। দাদাটা আবার একেবারে বোকা। ওর লিস্টটা আবার সব হাবিজাবি জিনিস দিয়ে ভরা। ঘুড়ি, লাটাই, ভালো মাঞ্জা, গল্পের বই এইসব। আমি ওর লিস্টটা দেখে হেসে গড়াগড়ি খাই। কি ভেবলা, পুজোর সময় কোথায় নতুন জামা কাপড় আর সাজগোজের জিনিস চাইবে, তা নয় সব উল্টোপাল্টা জিনিষ।
মাকেও লিস্ট বানাতে বলি। মা হেসে বলে তোদের নতুন হলেই হবে। আমি আর কোথায় যাব? শুনে আমার খুব অবাক লাগে। পাশের রুনু কাকিমণি কত বড় লিস্ট বানিয়ে রেখেছে তাপস কাকু আসলে কিনবে বলে। আমায় তমালী বলেছে। তমালী, রুনু কাকিমার মেয়ে। আসলে আমাদের গ্রামের অনেক মানুষই দূরে কোথাও কাজ করে। কেউ বছরে একবার বা বড়জোর দু-বার বাড়ি আসে। আর আমরা সবাই সেই দিনগুলির অপেক্ষায় বসে থাকি। তবে সবাই কিন্তু ফিরে আসে না। আমার প্রিয় বান্ধবী সোনালীর বাবা তো আজ দু বছর হয়ে গেল বাড়ি ফেরেনি। ওর দাদু শুনেছি থানায় গিয়েছিল, যদি তারা কোন খোঁজ দিতে পারে। কিন্তু এখনো তার কোনো খবর নেই।
গেলবার বাবা যখন বাড়ি ফিরেছিল সোনালীর দাদু বাবার কাছে এসে অনেক কাকুতি-মিনতি করেছিল, বাবা যদি তার কোন খোঁজ দিতে পারে। আমি দূর থেকে সব শুনতে পাচ্ছিলাম। খুব কষ্ট হচ্ছিল ।কিন্তু বাবাটাও যেন কেমন, তেড়ে গিয়ে বলল, "জেঠু ওর খবর আমার থেকে জানতে চাইবে না। যখন হাজার হাজার টাকা নিয়ে গ্রামে আসত তখন কি ওকে জিজ্ঞেস করেছিলে ও কোথা থেকে পাচ্ছে এত টাকা? যেমন কর্ম তেমন তার ফল।" দাদুটা চোখের জল মুছতে মুছতে আস্তে আস্তে চলে গেল। আমার মনে হচ্ছিল বাবাকে বলি, "সোনালী খুব কষ্টে আছে বাবা, তুমি ওর বাবাকে একটু খুঁজে এনে দাও না"।
পরে একসময় শুনতে পেলাম বাবা, মাকে বলেছে সোনালীর বাবা নাকি চুরির দায়ে জেলে আছে। কিন্তু এ কথা যেন পাঁচ কান না হয়। মনে মনে খুব ভয় পেয়ে গেলাম। আমি ঠিক করে নিয়েছিলাম আর বেশি বড় লিস্ট বাবাকে দেব না। শেষে বাবাকেও যদি চুরি করতে হয়। না কক্ষনো নয়। তাই এবারে পুজোর লিস্ট খুব ছোট। কিন্তু সেই শিউলি মাখা ফ্রকটা মন থেকে দূরই করতে পারছিলাম না।
মহালয়ার দিনটা ভারী মজা লাগে আমাদের। স্কুল ছুটি,তাই সবাই নিজের নিজের বন্ধুদের দল নিয়ে গঙ্গায় স্নান করতে যাই। বাড়ির বড়রা ও যায়। তারা তাদের মত পুজো আচ্চা করে, নিজেদের সুখ দুঃখের গল্প গুজব করে।
সেই রকমই আজও
সবাই গল্পে ব্যস্ত। আমরা ছোটরা, পুজোর লিস্টে কি কি আছে, কার বাবা বাড়ি ফেরার সময় কি কিনে নিয়ে আসবে ,এইসব আলোচনায় মেতে গেছি। আমিও বলি কি বলব না ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ করে বলেই দিলাম সেই শিউলি মাখা ফ্রকটার কথা। ইস্! তারপরই সোনালীর সেই শুকনো ফ্যাকাসে মুখটা দেখে মনটা হা -হুতাশ করে উঠল। এ আমি কি করলাম। মা বলেন, "তোমার কোন কথায় যদি কেউ কষ্ট পায় তাহলে ভগবান খুব রেগে যান।" তাহলে কি আমার ওই ফ্রকটা আর কেনা হবে না? এক রাশ হতাশা আমার বুকে চেপে বসলো।
এরপর থেকে রোজ ঠাকুর কে বলতাম, "ঠাকুর সোনালীর বাবাকে পাঠিয়ে দাও।তাহলে দুজনেই শিউলি মাখা ফ্রক কিনতে পারবো।"
আজ সপ্তমী। বাবা আজও বাড়ি ফেরেনি। আমি এক গা জ্বর নিয়ে বিছানায় বেঘোরে পড়ে আছি। ঘোরের মধ্যেই মনে হয় শুনতে পেলাম ঢাকের আওয়াজ, কলা বউ স্নানে চলল। স্নান করে উঠে নতুন শাড়িতে সাজবে কলাবৌ।
আমি মনে মনে ঠাকুর কে বললাম ,"মা দুর্গা, তুমি আর রাগ কোরো না। আমায় শিউলি মাখা জামাটা দিও না, শুধুমাত্র আমার বাবাকে পাঠিয়ে দাও।"
আবার কেমন ঘুম ঘুম পেতে লাগলো। ওই যেন ঢাকের আওয়াজ, না না ওইতো বাবা ডাকছে দূর থেকে, "রুপু !এই রুপু !ঘুমিয়ে পড়িস না যেন। আমি এসে গেছি।
Heartwarming story!
❤️